﴿ وَإِذۡ قُلۡتُمۡ يَٰمُوسَىٰ لَن نَّصۡبِرَ عَلَىٰ طَعَامٖ وَٰحِدٖ فَٱدۡعُ لَنَا رَبَّكَ يُخۡرِجۡ لَنَا مِمَّا تُنۢبِتُ ٱلۡأَرۡضُ مِنۢ بَقۡلِهَا وَقِثَّآئِهَا وَفُومِهَا وَعَدَسِهَا وَبَصَلِهَاۖ قَالَ أَتَسۡتَبۡدِلُونَ ٱلَّذِي هُوَ أَدۡنَىٰ بِٱلَّذِي هُوَ خَيۡرٌۚ ٱهۡبِطُواْ مِصۡرٗا فَإِنَّ لَكُم مَّا سَأَلۡتُمۡۗ وَضُرِبَتۡ عَلَيۡهِمُ ٱلذِّلَّةُ وَٱلۡمَسۡكَنَةُ وَبَآءُو بِغَضَبٖ مِّنَ ٱللَّهِۗ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمۡ كَانُواْ يَكۡفُرُونَ بَِٔايَٰتِ ٱللَّهِ وَيَقۡتُلُونَ ٱلنَّبِيِّۧنَ بِغَيۡرِ ٱلۡحَقِّۗ ذَٰلِكَ بِمَا عَصَواْ وَّكَانُواْ يَعۡتَدُونَ ٦١ ﴾ [البقرة: ٦١]
৬১. আর যখন তোমরা বললে, ‘হে মূসা, আমরা এক খাবারের ওপর কখনো ধৈর্য ধরবো না। সুতরাং তুমি আমাদের জন্য তোমার রবের নিকট দো’আ কর, যেনো তিনি আমাদের জন্য বের করেন, ভূমি যে সব্জি, কাঁকড়, রসুন, মসুর ও পেঁয়াজ উৎপন্ন করে, তা’। সে বলল, ‘তোমরা কি যা উত্তম তার পরিবর্তে এমন জিনিস গ্রহণ করছো যা নিম্নমানের? তোমরা কোনো এক নগরীতে অবতরণ কর। তবে নিশ্চয় তোমাদের জন্য (সেখানে) থাকবে, যা তোমরা চেয়েছ’। আর তাদের ওপর আরোপ করা হয়েছে লাঞ্ছনা ও দারিদ্র্য এবং তারা আল্লাহর ক্রোধের শিকার হল। তা এ কারণে যে, তারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে অস্বীকার করত৭৮ এবং অন্যায়ভাবে নবীদেরকে হত্যা করত। ৭৯ তা এ কারণে যে, তারা নাফরমানী করেছিল এবং তারা সীমালঙ্ঘন করত।৮০
৭৮. মহান আল্লাহর আয়াতসমূহকে অস্বীকার করার কয়েকটি অবস্থা রয়েছে:
ক. আল্লাহ-প্রদত্ত বিধি-বিধানের মধ্যে যেসব বিধান নিজের খেয়াল-খুশীর বিপরীত সেগুলো মানতে সরাসরি অস্বীকার করা।
খ. কোনো বিধানকে আল্লাহ-প্রদত্ত জেনেও গর্ব-অহংকারের সাথে তার বিপরীত কাজ করা এবং আল্লাহর নির্দেশের কোনো পরওয়া না করা।
গ. মহান রাব্বুল আ’লামীনের বাণীর মর্মার্থ ভালোভাবে জানা ও বুঝার পরও প্রবৃত্তির চাহিদা অনুসারে তার পরিবর্তন করা।
৭৯. বনী ইসরাঈল-কর্তৃক নবী-হত্যাসহ গুরুতর অপরাধসমূহের বিবরণ তাদের নিজেদের ইতিহাসেই লিপিবদ্ধ রয়েছে, তার দু-তিনটি উদাহরণ নীচে দেওয়া হলো। আপনি আগ্রহী হলে লিঙ্কগুলো দেখতে পারেন:
ক. ইয়াহ্ইয়া আ: (যোহন)-কে হত্যা: মার্ক, অধ্যায় - ৬, শ্লোক ১৭-২৯. http://www.asram.org/downloads/scriptorium/jbnew/Mark.pdf
খ. নবী ইয়ারমিয়ার (যেরেমিয়া) ওপর নির্যাতন: যেরেমিয়া, অধ্যায় - ১৮, শ্লোক ১৩-২৩
http://www.asram.org/downloads/scriptorium/jbold/Jeremiah.pdf
গ. যাকারিয়া আ:-কে প্রস্তরাঘাত করা:
http://www.asram.org/downloads/scriptorium/jbold/Zechariah.pdf
ঘ. ঈসা আ: এর বিরূদ্ধে মামলা, বিচার ও ফাঁসির রায়: মথি, অধ্যায় - ২৭, শ্লোক ২০-২৬
http://www.asram.org/downloads/scriptorium/jbnew/Matthew.pdf
৮০. যুগে যুগে যে সব জাতি মহান আল্লাহ তা‘আলার অসীম নিয়ামত ও নিদর্শন লাভের পরও সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম মানব তথা নবী-রাসূলদেরসহ সৎ, সত্য-পন্থী ও আল্লাহর পথে আহবানকারীদের নির্যাতন করেছে, বয়কট করেছে, হত্যা করেছে; অবাধ্যতা, সীমালংঘন আর মানুষের ন্যায্য অধিকার হরণের প্রতিযোগিতা করেছে, আর ফাসিক ও দুশ্চরিত্র লোকদের নেতৃত্বে নিজদেরকে চালিত করেছে - তাদের ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত অনিবার্য।
﴿ إِنَّ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَٱلَّذِينَ هَادُواْ وَٱلنَّصَٰرَىٰ وَٱلصَّٰبِِٔينَ مَنۡ ءَامَنَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ وَعَمِلَ صَٰلِحٗا فَلَهُمۡ أَجۡرُهُمۡ عِندَ رَبِّهِمۡ وَلَا خَوۡفٌ عَلَيۡهِمۡ وَلَا هُمۡ يَحۡزَنُونَ ٦٢ ﴾ [البقرة: ٦٢]
৬২. নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে, যারা ইয়াহূদী হয়েছে এবং খ্রিস্টান ও সাবিঈনরা-৮১ (তাদের মধ্যে) যারা ঈমান এনেছে আল্লাহ ও আখিরাতের দিনের প্রতি এবং নেক কাজ করেছে - তবে তাদের জন্য রয়েছে তাদের রবের নিকট তাদের প্রতিদান। আর তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।৮২
৮১. সাবেয়ীদের ধর্মীয় বিশ্বাস কি ছিল তা নির্ধারণের ক্ষেত্রে উলামাদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। ইমাম ইবনুল কাইয়েম রহমতুল্লাহি ‘আলাইহি. বলেছেন, সাবেয়ীদের ব্যাপারে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। ইমাম ইবনুল কাইয়েম রহমতুল্লাহি ‘আলাইহির মতে সাবেয়ীরা বৃহৎ একটি দল যাদের কেউ ছিল মু’মিন আবার কেউ কাফির। সাবেয়ীরা নবী-রাসূলদের অস্বীকার করত না, তবে তাদের আনুগত্যকেও বাধ্যতামূলক মনে করত না। তারা সর্বজ্ঞাত প্রজ্ঞাময় আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করত তবে তাদের অধিকাংশের বক্তব্য ছিল, মাধ্যম গ্রহণ ব্যতীত আল্লাহর কাছে পৌঁছা কখনো সম্ভব নয়। তাই তারা ঐসব মাধ্যমকে উপাসনার পাত্ররূপে গ্রহণ করে নিয়েছিল। সাবেয়ীরা যে ধর্মে যে বিষয়টাকে ভালো মনে করত তারা সেটাকেই আপন করে নিত। তারা সুনির্দিষ্ট কোনো সম্প্রদায়ের পক্ষপাতিত্ব করত না; বরং সাবেয়ীদের কাছে সকল ধর্মের বিধানগুলো পৃথিবীর কল্যাণার্থেই প্রবর্তিত হয়েছে।
তবে সাবেয়ীরা দুটি মৌল ধারায় বিভক্ত ছিল বলে অনেকেই উল্লেখ করেছেন। একটি ধারায় ছিল হুনাফা, অর্থাৎ একত্ববাদী সাবেয়ীরা, আরেকটি ছিল মুশরিক সাবেয়ীরা। (দ্র: আররাদ্দু আলাল মান্তেকিয়ীন: ১৮৭-৪৫৪, ২৯০-৪৫৮ )
৮২. মহান আল্লাহর কাছে মূল্য ও মর্যাদা একমাত্র যথাযথ ঈমান ও সৎ কাজের। যে ব্যক্তি এ সম্পদ নিয়ে তাঁর সামনে হাযির হতে পারবে, সে লাভ করবে পূর্ণ পুরস্কার।
﴿ وَإِذۡ أَخَذۡنَا مِيثَٰقَكُمۡ وَرَفَعۡنَا فَوۡقَكُمُ ٱلطُّورَ خُذُواْ مَآ ءَاتَيۡنَٰكُم بِقُوَّةٖ وَٱذۡكُرُواْ مَا فِيهِ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ٦٣ ثُمَّ تَوَلَّيۡتُم مِّنۢ بَعۡدِ ذَٰلِكَۖ فَلَوۡلَا فَضۡلُ ٱللَّهِ عَلَيۡكُمۡ وَرَحۡمَتُهُۥ لَكُنتُم مِّنَ ٱلۡخَٰسِرِينَ ٦٤ ﴾ [البقرة: ٦٣، ٦٤]
৬৩-৬৪. আর স্মরণ কর, যখন আমি তোমাদের অঙ্গীকার গ্রহণ করলাম এবং তূর পাহাড়কে তোমাদের ওপর উঠালাম।৮৪ আমি (বললাম) ‘তোমাদেরকে যা দিয়েছি, তা শক্তভাবে ধর এবং তাতে যা রয়েছে তা স্মরণ কর, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পার’।৮৫
অতঃপর তোমরা এ সবের পর বিমুখ হয়ে ফিরে গেলে। আর যদি তোমাদের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত না হত, তোমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হতে।৮৬
৮৫. মুত্তাকী তারা যারা সবসময় দয়াময় আল্লাহর ক্ষমা ও পুরস্কার লাভের আশায় সতর্কাবস্থায় চলে এবং সৎকাজে সদা তৎপর থাকে; আর মহাবিচার দিনের মালিক আল্লাহর শাস্তিকে সব সময় ভয় পায়, তাই সদা সর্বদা অন্যায়-অসৎ কাজ থেকে দূরে থাকে।
৮৬. এ হলো করুণাময় আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর পরম প্রিয়সৃষ্টি মানুষকে - জোর করে চাপিয়ে দিয়ে নয়- বরং নিজ আগ্রহে সংশোধিত হয়ে তাঁর ক্ষমা লাভে ধন্য হবার সুযোগ যা বার বার মানুষের দরজায় কড়া নাড়ে। তারপরেও কি আমাদের তাঁর সন্তষ্টির পথে পুরোপুরি ফিরে এসে আলোকিত জীবন গড়ার সময় হবে না?
﴿ وَلَقَدۡ عَلِمۡتُمُ ٱلَّذِينَ ٱعۡتَدَوۡاْ مِنكُمۡ فِي ٱلسَّبۡتِ فَقُلۡنَا لَهُمۡ كُونُواْ قِرَدَةً خَٰسِِٔينَ ٦٥ فَجَعَلۡنَٰهَا نَكَٰلٗا لِّمَا بَيۡنَ يَدَيۡهَا وَمَا خَلۡفَهَا وَمَوۡعِظَةٗ لِّلۡمُتَّقِينَ ٦٦ ﴾ [البقرة: ٦٥، ٦٦]
৬৫. আর তোমাদের মধ্যে যারা শনিবারের৮৭ ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করেছিল, তাদেরকে অবশ্যই তোমরা জান। অতঃপর আমি তাদেরকে বললাম, ‘তোমরা নিকৃষ্ট বানর হয়ে যাও’।৮৮
৬৬. আর আমি একে বানিয়েছি দৃষ্টান্ত, সে সময়ের এবং তৎপরবর্তী জনপদসমূহের জন্য এবং মুত্তাকীদের জন্য উপদেশস্বরূপ।
৮৭. ‘সাব্ত’ অর্থ কালের একটি ক্ষণ যা আরাম-বিশ্রামের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়। বনী ইসরাঈলের প্রতি এ বিধান ছিল যে, শনিবার দিনকে তারা বিশ্রাম ও ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট রাখবে। এদিনে তারা পার্থিব কোনো কাজ-কর্ম নিজেরা বা পরিচারকদের দিয়েও করাতে পারবে না। এ প্রসঙ্গে এমন কড়া আইন ছিল যে, এ পবিত্র দিনের নির্দেশ অমান্যকারীর শাস্তি ছিল মৃত্যুদন্ড। বর্তমান বিকৃত বাইবেলেও (যাত্রা পুস্তক: অধ্যায় ৩১, শ্লোক ১২-১৭) এ নির্দেশনাটি দেখতে পাবেন এ লিঙ্কে-
http://www.asram.org/downloads/scriptorium/jbold/Exodus.pdfhttp://www.asram.org/downloads/scriptorium/jbold/Exodus.pdf
কিন্তু তারা নৈতিক ও ধর্মীয় পতনের শিকার হবার পর এ বিধানের সুস্পষ্ট অবমাননা করতে থাকে। এমনকি তাদের শহরগুলোতে শনিবারে প্রকাশ্যে চলতে থাকে সব ধরনের কাজ-কর্ম ও ব্যবসা-বাণিজ্য।
৮৮. তাদেরকে বানরে পরিণত করার অর্থ তাদের মস্তিষ্ক ও চিন্তাশক্তিকে পূর্ববৎ রেখে শারীরিক বিকৃতি ঘটিয়ে বানরে রূপান্তরিত করা হয়েছিল।
# আরো বিস্তারিত জানতে দেখুন: সূরা আল-আরাফ, আয়াত ১৬৩-১৭১।
﴿ وَإِذۡ قَالَ مُوسَىٰ لِقَوۡمِهِۦٓ إِنَّ ٱللَّهَ يَأۡمُرُكُمۡ أَن تَذۡبَحُواْ بَقَرَةٗۖ قَالُوٓاْ أَتَتَّخِذُنَا هُزُوٗاۖ قَالَ أَعُوذُ بِٱللَّهِ أَنۡ أَكُونَ مِنَ ٱلۡجَٰهِلِينَ ٦٧ قَالُواْ ٱدۡعُ لَنَا رَبَّكَ يُبَيِّن لَّنَا مَا هِيَۚ قَالَ إِنَّهُۥ يَقُولُ إِنَّهَا بَقَرَةٞ لَّا فَارِضٞ وَلَا بِكۡرٌ عَوَانُۢ بَيۡنَ ذَٰلِكَۖ فَٱفۡعَلُواْ مَا تُؤۡمَرُونَ ٦٨ ﴾ [البقرة: ٦٧، ٦٨]
৬৭. আর স্মরণ কর, যখন মূসা তার কওমকে বলল, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা একটি গাভী যবেহ করবে’।৮৯ তারা বলল, ‘তুমি কি আমাদের সাথে উপহাস করছ?’ সে বলল, ‘আমি মূর্খদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাচ্ছি।’৯০
৬৮. তারা বলল, ‘তুমি আমাদের জন্য তোমার রবের নিকট দোআ কর, তিনি যেনো আমাদের জন্য স্পষ্ট করে দেন গাভীটি কেমন হবে।’ সে বলল, ‘নিশ্চয় তিনি বলছেন, নিশ্চয় তা হবে গরু, বুড়ো নয় এবং বাচ্চাও নয়। এর মাঝামাঝি ধরনের। সুতরাং তোমরা কর যা তোমাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।’৯১
৮৯. এ আয়াতের ‘বাকারাহ’ (গাভী) শব্দ থেকেই এ সূরার নামকরণ করা হয়েছে।
৯০. এখানে উল্লেখিত ঘটনাটি সংক্ষেপে এ যে, বনী ইসরাঈলের মধ্যে একটি হত্যাকান্ড ঘটেছিল; কিন্তু হত্যাকারীকে সনাক্ত করা যাচ্ছিল না। তাই তারা মূসা ‘আলাইহিস সালামের স্মরণাপন্ন হয়। আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে দিয়ে একটি গাভী যবেহ-এর মাধ্যমে নিহত লোকটিকে জীবিত করে তার হত্যাকারীর পরিচয় উদঘাটন করান। এটি ছিল একটি অলৌকিক ঘটনা।
৯১. আসলে মহান আল্লাহর নির্দেশ পেয়ে যে কোনো একটি গাভী কুরবানী করাই যথেষ্ট ছিল, কিন্তু দ্বীনের যে কোনো বিধান পালনে অযথা সন্দেহ-সংশয়, অন্বেষণ ও প্রশ্ন করা ছিল তাদের চিরাচরিত স্বভাব।
﴿ قَالُواْ ٱدۡعُ لَنَا رَبَّكَ يُبَيِّن لَّنَا مَا هِيَۚ قَالَ إِنَّهُۥ يَقُولُ إِنَّهَا بَقَرَةٞ لَّا فَارِضٞ وَلَا بِكۡرٌ عَوَانُۢ بَيۡنَ ذَٰلِكَۖ فَٱفۡعَلُواْ مَا تُؤۡمَرُونَ ٦٨ قَالُواْ ٱدۡعُ لَنَا رَبَّكَ يُبَيِّن لَّنَا مَا لَوۡنُهَاۚ قَالَ إِنَّهُۥ يَقُولُ إِنَّهَا بَقَرَةٞ صَفۡرَآءُ فَاقِعٞ لَّوۡنُهَا تَسُرُّ ٱلنَّٰظِرِينَ ٦٩ قَالُواْ ٱدۡعُ لَنَا رَبَّكَ يُبَيِّن لَّنَا مَا هِيَ إِنَّ ٱلۡبَقَرَ تَشَٰبَهَ عَلَيۡنَا وَإِنَّآ إِن شَآءَ ٱللَّهُ لَمُهۡتَدُونَ ٧٠ قَالَ إِنَّهُۥ يَقُولُ إِنَّهَا بَقَرَةٞ لَّا ذَلُولٞ تُثِيرُ ٱلۡأَرۡضَ وَلَا تَسۡقِي ٱلۡحَرۡثَ مُسَلَّمَةٞ لَّا شِيَةَ فِيهَاۚ قَالُواْ ٱلۡـَٰٔنَ جِئۡتَ بِٱلۡحَقِّۚ فَذَبَحُوهَا وَمَا كَادُواْ يَفۡعَلُونَ ٧١ ﴾ [البقرة: ٦٨، ٧١]
৬৯. তারা বলল,৯২ ‘তুমি আমাদের জন্য তোমার রবের নিকট দোআ কর, তিনি যেনো আমাদের জন্য স্পষ্ট করে দেন, কেমন তার রঙ?’ সে বলল, ‘নিশ্চয় তিনি বলছেন, নিশ্চয় তা হবে হলুদ রঙের গাভী, তার রঙ উজ্জ্বল, দর্শকদেরকে যা আনন্দ দেবে।’
৭০. তারা বলল, ‘তুমি আমাদের জন্য তোমার রবের নিকট দোআ কর, তিনি যেনো আমাদের জন্য স্পষ্ট করে দেন, তা কেমন? নিশ্চয় গরুটি আমাদের জন্য সন্দেহপূর্ণ হয়ে গিয়েছে। আর নিশ্চয় আমরা আল্লাহ চাহে তো পথপ্রাপ্ত হব।’
৭১. সে বলল, ‘নিশ্চয় তিনি বলছেন, ‘নিশ্চয় তা এমন গাভী, যা ব্যবহৃত হয়নি জমি চাষ করায় আর না ক্ষেতে পানি দেয়ায়। সুস্থ, যাতে কোনো খুঁত নেই।’ তারা বলল, ‘এখন তুমি সত্য নিয়ে এসেছ।’ অতঃপর তারা তা যবেহ করল অথচ তারা যবেহ করার ছিল না।৯৩
৯২. পূর্বের দুটি আয়াতের সাথে মিলিয়ে অধ্যয়ন করলে মর্মার্থ বুঝা সহজ হবে। গাভী সম্পর্কে বনী ইসরাঈলের বিভিন্ন প্রশ্ন ও সন্দেহ নিরসন চলছে।
৯৩. বনী ইসরাঈলের লোকেরা তৎকালীন মিশরের ফিরাউনের যুলুম ও অত্যাচার থেকে মহান আল্লাহর অসীম-অলৌকিক সাহায্যে মুক্তিলাভের পর সিনাই উপদ্বীপে অবস্থান নেয়। এসময় আশপাশের গো-পূজারী জাতিসমূহ থেকে তাদের মাঝে ‘গাভীর শ্রেষ্ঠত্ব ও পবিত্রতার’ ছোঁয়াচে রোগ ছড়িয়ে পড়ে; আর তারা শুরু করে দেয় গো-বৎস পূজা। ঐ গর্হিত কাজ থেকে ফিরিয়ে আনতে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে গাভী কুরবানীর নির্দেশ দিলেন। এটি তাদের জন্যে ছিল ঈমানের এক কঠিন পরীক্ষা। তাই তারা এ আদেশ এড়িয়ে যেতে বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপন করতে থাকে; কিন্তু তার জবাবে সে ‘সোনালী বর্ণের বিশেষ ধরনের গাভী’ই তাদের সামনে এসে পড়ে, যাকে সে সময় তারা পূজা করতো!
বর্তমান বিকৃত বাইবেলের গণনা পুস্তকের ১৯ অধ্যায়ের ১-১০ শ্লোকগুলোতে এ ঘটনার ইঙ্গিত রয়েছে ।
http://www.asram.org/downloads/scriptorium/jbold/Numbers.pdf
﴿ وَإِذۡ قَتَلۡتُمۡ نَفۡسٗا فَٱدَّٰرَٰٔتُمۡ فِيهَاۖ وَٱللَّهُ مُخۡرِجٞ مَّا كُنتُمۡ تَكۡتُمُونَ ٧٢ ﴾ [البقرة: ٧٢]
৭২. আর স্মরণ কর, যখন তোমরা একজনকে হত্যা করলে অতঃপর সে ব্যাপারে একে অপরকে দোষারোপ করলে। আর আল্লাহ বের করে দিলেন তোমরা যা গোপন করছিলে।
﴿ فَقُلۡنَا ٱضۡرِبُوهُ بِبَعۡضِهَاۚ كَذَٰلِكَ يُحۡيِ ٱللَّهُ ٱلۡمَوۡتَىٰ وَيُرِيكُمۡ ءَايَٰتِهِۦ لَعَلَّكُمۡ تَعۡقِلُونَ ٧٣ ﴾ [البقرة: ٧٣]
৭৩. অতঃপর আমি বললাম, ‘তোমরা তাকে আঘাত কর গাভীটির (গোস্তের) কিছু অংশ দিয়ে। এভাবে আল্লাহ জীবিত করেন মৃতদেরকে। আর তিনি তোমাদেরকে তাঁর নিদর্শনসমূহ দেখান, যাতে তোমরা বুঝ।৯৪
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
৯৪. এটি ছিল বনী ইসরাঈলের সময়ের অসংখ্য মুজিযা বা অলৌকিক ঘটনার একটি। এখানে নিহত ব্যক্তি শুধুমাত্র তার হন্তার পরিচয় বলতে প্রয়োজনীয় সময়ের জন্য মহান আল্লাহর নির্দেশে জীবন ফিরে পেয়েছিল।
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------
﴿ ثُمَّ قَسَتۡ قُلُوبُكُم مِّنۢ بَعۡدِ ذَٰلِكَ فَهِيَ كَٱلۡحِجَارَةِ أَوۡ أَشَدُّ قَسۡوَةٗۚ وَإِنَّ مِنَ ٱلۡحِجَارَةِ لَمَا يَتَفَجَّرُ مِنۡهُ ٱلۡأَنۡهَٰرُۚ وَإِنَّ مِنۡهَا لَمَا يَشَّقَّقُ فَيَخۡرُجُ مِنۡهُ ٱلۡمَآءُۚ وَإِنَّ مِنۡهَا لَمَا يَهۡبِطُ مِنۡ خَشۡيَةِ ٱللَّهِۗ وَمَا ٱللَّهُ بِغَٰفِلٍ عَمَّا تَعۡمَلُونَ ٧٤ ﴾ [البقرة: ٧٤]
৭৪. অতঃপর তোমাদের অন্তরসমূহ এর পরে কঠিন হয়ে গেল যেনো তা পাথরের মত কিংবা তার চেয়েও শক্ত। আর নিশ্চয় পাথরের মধ্যে কিছু আছে, যা থেকে নহর উৎসারিত হয়। আর নিশ্চয় তার মধ্যে কিছু আছে যা চূর্ণ হয়। ফলে তা থেকে পানি বের হয়। আর নিশ্চয় তার মধ্যে কিছু আছে যা আল্লাহর ভয়ে ধ্বসে পড়ে।৯৫ আর আল্লাহ তোমরা যা কর, সে সম্পর্কে গাফেল নন।
৯৫. উপমাটি অত্যন্ত মর্মস্পর্শী। পাথর আপাতঃ দৃষ্টিতে এক নির্জীব প্রাকৃতিক কঠিন বস্তু; কিন্তু তার মাঝেও রয়েছে কোমলতা, যার অনুপম বর্ণনা করেছেন স্বয়ং তার সৃষ্টিকর্তা। এ বস্তুটির সাথে মানুষের হৃদয়ের তুলনা করেছেন রাব্বুল আলামীন। এখানে ৩ ধরনের পাথরের উল্লেখ করা হয়েছে:
ক. যা থেকে প্রবাহিত হয় ঝরনাধারা তথা নদী-নালা, যা সৃষ্ট জীবের উপকারে আসে।
খ. যা ফেটে গলে বের হয়ে আসে পানি, অর্থাৎ বাইরে কঠিন হলেও অন্তঃস্থল সুকোমল;
গ. কিছু পাথর, আরো সংবেদনশীল, যা যমীনে ধ্বসে পড়ে মহান আল্লাহর ভয়ে।
কিন্তু মানুষের মাঝে এমনও কিছু হৃদয় আছে, বিশেষতঃ এ আয়াতের প্রাসঙ্গিকতায় উল্লেখিত ইয়াহূদীদের অন্তর এতোই কঠিন যে, সৃষ্ট-জীবের দুঃখ-দুর্দশায়ও ঐ পাষাণদের চোখ অশ্রুসজল হয় না, আল্লাহর আক্রোশের ভয়ে হৃদয়গুলো এতটুকু প্রকম্পিত হয় না, অন্তরগুলো বিগলিত হয় না আল্লাহর কুদরতের অসংখ্য নিদর্শন দেখেও।
﴿ ۞أَفَتَطۡمَعُونَ أَن يُؤۡمِنُواْ لَكُمۡ وَقَدۡ كَانَ فَرِيقٞ مِّنۡهُمۡ يَسۡمَعُونَ كَلَٰمَ ٱللَّهِ ثُمَّ يُحَرِّفُونَهُۥ مِنۢ بَعۡدِ مَا عَقَلُوهُ وَهُمۡ يَعۡلَمُونَ ٧٥ ﴾ [البقرة: ٧٥]
৭৫. তোমরা কি এ আশা করছো যে, তারা তোমাদের প্রতি ঈমান আনবে? অথচ তাদের একটি দল ছিল৯৬ যারা আল্লাহর বাণী শুনত,৯৭ অতঃপর তা বুঝে নেওয়ার পর তা তারা বিকৃত করত জেনে বুঝে।৯৮
৯৬. বনী ইসরাঈলের আলেম-ওলামা ও শরীয়তের ব্যাখ্যাতাদের বুঝানো হয়েছে।
৯৭. তাওরাত, যাবূর ও অন্যান্য কিতাবকে বুঝানো হয়েছে, যা নবীদের মাধ্যমে তাদের কাছে পৌঁছেছে।
৯৮. ‘তাহরীফ’ অর্থ বিকৃতি বা পরিবর্তন; যা দু’ভাবে হতে পারে:
ক. কথার মূল অর্থ গোপন রেখে নিজ ইচ্ছা, প্রবৃত্তি ও সুবিধার অনুকূলে তার ব্যাখ্যা করা, যা মূল বক্তার লক্ষ্য ও ইচ্ছার খেলাফ।
খ. উদ্দেশ্যমূলকভাবে বাক্যের শব্দ পরিবর্তন।
বনী ইসরাঈলের আলেমগণ আল্লাহর কিতাবে এ উভয় ধরনের বিকৃতিই করেছে।
﴿ وَإِذَا لَقُواْ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ قَالُوٓاْ ءَامَنَّا وَإِذَا خَلَا بَعۡضُهُمۡ إِلَىٰ بَعۡضٖ قَالُوٓاْ أَتُحَدِّثُونَهُم بِمَا فَتَحَ ٱللَّهُ عَلَيۡكُمۡ لِيُحَآجُّوكُم بِهِۦ عِندَ رَبِّكُمۡۚ أَفَلَا تَعۡقِلُونَ ٧٦ ﴾ [البقرة: ٧٦]
৭৬. আর যখন তারা মু’মিনদের সাথে সাক্ষাৎ করে তখন বলে, ‘আমরা ঈমান এনেছি।’ আর যখন একে অপরের সাথে একান্তে মিলিত হয় তখন বলে, ‘তোমরা কি তাদের সাথে সে কথা আলোচনা কর, যা আল্লাহ তোমাদের ওপর উম্মুক্ত করেছেন, যাতে তারা এর মাধ্যমে তোমাদের রবের নিকট তোমাদের বিরুদ্ধে দলীল পেশ করবে?৯৯ তবে কি তোমরা বুঝো না’?১০০
৯৯. আতা ইবন ইয়াসির রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর সাথে সাক্ষাত করে তাঁকে বললাম, তাওরাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যে বৈশিষ্ট্য ও পরিচয় (বর্ণিত) আছে সে সম্পর্কে আমাকে অবহিত করুন। তিনি বলেন, হ্যাঁ, ঠিক কথা। কুরআনে বর্ণিত তাঁর গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যের কিছুটা তাওরাতে উল্লেখিত হয়েছে: ‘হে নবী! আমি আপনাকে (সত্য-দ্বীনের) সাক্ষ্যদাতা, সুসংবাদদাতা এবং সতর্ককারী হিসেবে প্রেরণ করেছি এবং উম্মিদের রক্ষাকারী হিসেবে পাঠিয়েছি। আপনি আমার বান্দা ও রাসূল। আমি আপনার নাম দিয়েছি মুতাওয়াক্কিল বা ভরসাকারী। আপনি দুশ্চরিত্র বা রূঢ় ও কঠোর হৃদয় নন এবং বাজারে ঝগড়া ও হৈ-হুল্লোড়কারী নন’। (আপনি এমন ব্যক্তি) যে কোনো মন্দ দিয়ে মন্দকে প্রতিহতকারী নয়, বরং মাফ করে দেয়। আল্লাহ তাঁকে (মৃত্যু দিয়ে) ততদিন পর্যন্ত দুনিয়া থেকে উঠিয়ে নেবেন না যতদিন না সবাই ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ (আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই) একথা স্বীকার করার মাধ্যমে সৎপথের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় এবং তা দিয়ে অন্ধের চোখ, বধিরের কান এবং (অসত্যের অন্ধকারে) আচ্ছাদিত হৃদয় ও মন-মানসিকতা উন্মুক্ত না হয়ে যায়। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯৭৭)
১০০. ইয়াহূদীদের নিজেদের মধ্যে আলোচিত ছিল যে, তাওরাত ও অন্যান্য আসমানী কিতাবে মহানবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে যেসব ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে এবং যে সব আয়াত ও শিক্ষাবলী তাদের পবিত্র কিতাবসমূহে রয়েছে যা দিয়ে তাদের মানসিকতা ও কর্মনীতিকে দোষারোপ করা যায় সেগুলো যেনো মুসলিমদের কাছে প্রকাশ না পায়; কিন্তু তা ছিল এক ব্যর্থ চেষ্টা-দেখুন পরবর্তী আয়াত।
﴿ أَوَ لَا يَعۡلَمُونَ أَنَّ ٱللَّهَ يَعۡلَمُ مَا يُسِرُّونَ وَمَا يُعۡلِنُونَ ٧٧ ﴾ [البقرة: ٧٧]
৭৭. তারা কি জানে না যে, তারা যা গোপন করে এবং যা প্রকাশ করে, তা আল্লাহ জানেন?
﴿ وَمِنۡهُمۡ أُمِّيُّونَ لَا يَعۡلَمُونَ ٱلۡكِتَٰبَ إِلَّآ أَمَانِيَّ وَإِنۡ هُمۡ إِلَّا يَظُنُّونَ ٧٨ ﴾ [البقرة: ٧٨]
৭৮. আর তাদের মধ্যে আছে নিরক্ষর,১০১ তারা মিথ্যা আকাঙ্খা ছাড়া কিতাবের কোনো জ্ঞান রাখে না এবং তারা শুধুই ধারণা করে থাকে।১০২
১০১. এখানে ইয়াহূদীদের দ্বিতীয় ধরনের লোকদের তথা জনসাধারণের অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। আর প্রথম ধরনের দলটি ছিল তাদের আলেম-ওলামা ও শরীয়তের ব্যাখ্যাতাদের, যার উল্লেখ ছিল ৭৫নং আয়াতে।
১০২. আল্লাহর কিতাবের কোনো জ্ঞানই তাদের ছিল না, তাতে দ্বীনের কি বিধি-বিধান রয়েছে, চারিত্রিক সংশোধন ও শরীয়তের নিয়ম-নীতি তথা মানবজীবনের প্রকৃত সাফল্য ও ব্যর্থতা কিসের ওপর নির্ভরশীল, তার প্রতি তাদের মোটেও মনোযোগ ছিল না। ওহীর জ্ঞানের প্রতি আগ্রহী না হয়ে তারা নিজেদের ইচ্ছা-আকাঙ্খা অনুসারে নিজেদের মনগড়া কথাগুলোকে দ্বীন মনে করতো, আর মিথ্যামিথ্যি রচিত কিস্সা-কাহিনী আর ধারণা-অনুমানের ওপর ভর করে কালাতিপাত করতো।
এখানে গভীর আশংকার সাথে উল্লেখ্য যে, বর্তমান বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠির অবস্থাও অনেক ক্ষেত্রে অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে অনুরূপ, যা আমাদের চলমান সামগ্রিক অধঃপতনের অন্যতম কারণ। এ পরিস্থিতি থেকে অনতিবিলম্বে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে, আমাদের অস্তিত্ব রক্ষা এবং প্রকৃত কল্যাণের স্বার্থেই।
﴿ فَوَيۡلٞ لِّلَّذِينَ يَكۡتُبُونَ ٱلۡكِتَٰبَ بِأَيۡدِيهِمۡ ثُمَّ يَقُولُونَ هَٰذَا مِنۡ عِندِ ٱللَّهِ لِيَشۡتَرُواْ بِهِۦ ثَمَنٗا قَلِيلٗاۖ فَوَيۡلٞ لَّهُم مِّمَّا كَتَبَتۡ أَيۡدِيهِمۡ وَوَيۡلٞ لَّهُم مِّمَّا يَكۡسِبُونَ ٧٩ ﴾ [البقرة: ٧٩]
৭৯. সুতরাং ধ্বংস তাদের জন্য যারা নিজ হাতে কিতাব লিখে। তারপর বলে, ‘এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে’, যাতে তা তুচ্ছ মূল্যে বিক্রি করতে পারে।১০৩ সুতরাং তাদের হাত যা লিখেছে তার পরিণামে তাদের জন্য ধ্বংস, আর তারা যা উপার্জন করেছে তার কারণেও তাদের জন্য ধ্বংস।
১০৩. যুগে যুগে আসমানী কিতাবকে বিকৃত করে বিভিন্ন ভাষ্যকারের মনগড়া বিশ্লেষণ, মুখরোচক কল্প-কাহিনী জুড়ে দেওয়া এবং উদ্ভাবিত সুবিধাজনক ও জনপ্রিয় আইন-কানুনের সংযোজনের মূল উদ্দেশ্য হলো সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিয়ে দুনিয়ার সাময়িক স্বার্থ, অর্থ বা অবস্থান লাভ করা। যার অসংখ্য উদাহরণ বিদ্যমান রয়েছে অতীতের সব আসমানী কিতাব, ধর্মগ্রন্থ ও তাদের রক্ষকদের(!) মধ্যে।
এ থেকে আমাদের দীন-শরিয়া ও জীবন-ব্যবস্থার বিধি-বিধানের ব্যাখ্যাতাদের শিক্ষা নেওয়ার অবকাশ রয়েছে।
তবে একমাত্র এবং শুধুমাত্র আসমানী কিতাব মহাগ্রন্থ আল-কুরআনকে প্রায় দেড় হাজার বছরেও কেউ, কোনো শক্তি আজ পর্যন্ত তার কোনো শব্দ এমনকি একটি অক্ষরও স্পর্শ করতে পারেনি, আর পারবেও না; যা সমগ্র মানবজাতির সামনে অনন্তকালের জন্য এক জাজ্জ্বল্যমান মু‘জিযা। কারণ, এর সুসংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। তিনি বলেছেন,
﴿ إِنَّا نَحۡنُ نَزَّلۡنَا ٱلذِّكۡرَ وَإِنَّا لَهُۥ لَحَٰفِظُونَ ٩ ﴾ [الحجر: ٩]
আমি স্বয়ং এ উপদেশগ্রন্থ অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই এর সংরক্ষক। [সূরা আল-হিজর, আয়াত: ৯]
﴿ وَقَالُواْ لَن تَمَسَّنَا ٱلنَّارُ إِلَّآ أَيَّامٗا مَّعۡدُودَةٗۚ قُلۡ أَتَّخَذۡتُمۡ عِندَ ٱللَّهِ عَهۡدٗا فَلَن يُخۡلِفَ ٱللَّهُ عَهۡدَهُۥٓۖ أَمۡ تَقُولُونَ عَلَى ٱللَّهِ مَا لَا تَعۡلَمُونَ ٨٠ ﴾ [البقرة: ٨٠]
৮০. আর তারা বলে, ‘গোনা-কয়েকদিন ছাড়া আগুন আমাদেরকে কখনো স্পর্শ করবে না’।১০৪ বল, ‘তোমরা কি আল্লাহর নিকট ওয়াদা নিয়েছ, ফলে আল্লাহ তাঁর ওয়াদা ভঙ্গ করবেন না?১০৫ নাকি আল্লাহর ওপর এমন কিছু বলছ, যা তোমরা জান না’?
১০৪. এটি ছিল ইয়াহূদী সমাজের একটি সাধারণ ভুল ধারণা। তারা ভাবতো, যেহেতু তারা ইয়াহূদী, তাই জাহান্নামের আগুন তাদের জন্য নিষিদ্ধ। আর যদি তাদেরকে শাস্তি দেয়াও হয়, তাহলে তা হাতে-গোনা কয়েকদিনের জন্য মাত্র, তারপর তাদেরকে জান্নাতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে!
১০৫. মুফাস্সিরগণের মতে, যদি আল্লাহ ক্ষমা না করেন তবে ঈমানদার ব্যক্তি গুনাহগার হলে জাহান্নামের শাস্তি পাবে, তবে চিরকালের জন্য নয়, শাস্তি ভোগের পর মুক্তি পাবে।
ইয়াহূদীদের বিশ্বাস, মূসা আ:-এর ধর্ম রহিত হয়নি, তাই তারা ঈমানদার এবং তাঁর পরবর্তী নবী ঈসা আ: ও শেষনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াত অস্বীকার করলেও তারা কাফির নয়, যা সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। কারণ কোনো আসমানী কিতাবেই এটি লেখা নেই যে, মূসা এবং ঈসা ‘আলাইহিমুস সালামের আনীত দীন হলো চিরকালের জন্যে; বরং পরবর্তী এবং শেষ নবীর পূর্বাভাষ রয়েছে তাদের কিতাবে। অনেকগুলো প্রমাণের একটি এখানে দেখুন: দ্বিতীয় বিবরণ, অধ্যায় ১৮, শ্লোক ১৫-১৯ এ লিঙ্কে http://www.asram.org/downloads/scriptorium/jbold/Deuteronomy.pdfhttp://www.asram.org/downloads/scriptorium/jbold/Deuteronomy.pdf।
শেষনবীর উম্মত হিসেবে তাঁর নবুওয়াতের প্রতি ঈমান পোষণ করা সন্দেহাতীতভাবে অপরিহার্য। কাজেই নবুওয়াত অস্বীকারকারী কাফির; আর কাফিররা কিছুদিন শাস্তি ভোগ করে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে - একথাও কোনো আসমানী কিতাবে উল্লেখ নেই।
﴿ بَلَىٰۚ مَن كَسَبَ سَيِّئَةٗ وَأَحَٰطَتۡ بِهِۦ خَطِيَٓٔتُهُۥ فَأُوْلَٰٓئِكَ أَصۡحَٰبُ ٱلنَّارِۖ هُمۡ فِيهَا خَٰلِدُونَ ٨١ ﴾ [البقرة: ٨١]
৮১. হাঁ, যে মন্দ উপার্জন করবে এবং তার পাপ তাকে বেষ্টন করে নেবে,১০৬ তারাই জাহান্নামের অধিবাসী। তারা সেখানে থাকবে স্থায়ীভাবে।
১০৬. ‘গুনাহ দিয়ে পরিবেষ্টিত হওয়া’ শুধুমাত্র (মহাসত্যগুলোকে অস্বীকারকারী) কাফিরদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কারণ, কুফরের ফলে তাদের কোনো সৎকর্মই গ্রহণযোগ্য হয় না। এমনকি কুফরের পূর্বে কিছু ভালো কাজ করে থাকলেও তা মূল্যহীন হয়ে পড়ে। এজন্যে একথার মর্মার্থ এ যে, কাফিরদের গোটা সত্ত্বা ও কৃতকর্মগুলো যেনো নিরেট অপরাধ ও অবাধ্যতাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে থাকে; সত্যের আলো যেনো গাঢ় অন্ধকারের বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা তাদের অস্তিত্বে প্রবেশের কোনো পথ আর খুঁজে পায় না। তাই তাদের পরিণতি এতো ভয়াবহ।
﴿ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّٰلِحَٰتِ أُوْلَٰٓئِكَ أَصۡحَٰبُ ٱلۡجَنَّةِۖ هُمۡ فِيهَا خَٰلِدُونَ ٨٢ ﴾ [البقرة: ٨٢]
৮২. আর যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে,১০৭ তারা জান্নাতের অধিবাসী। তারা সেখানে থাকবে স্থায়ীভাবে।
১০৭. ঈমানদারদের অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
প্রথমতঃ ঈমানের জন্যে নির্দেশিত ও প্রয়োজনীয়, আপাতঃদৃষ্টিতে ‘অদৃশ্য ও দৃশ্যমান’ অনেক বিষয়ের ওপর নির্ভেজাল বিশ্বাস ও প্রত্যয় ধারণ করাটাই এক বিরাট সৎকর্ম।
দ্বিতীয়তঃ দুনিয়ার জীবনে পরিলক্ষিত তথাকথিত অফুরন্ত চাকচিক্য, আরাম-আয়েশ, অবৈধ উপার্জন আর ভোগের হাতছানিগুলোকে ধোঁকা হিসেবে বিবেচনা করে সচেতনভাবে এড়িয়ে চলে, শয়তানের সার্বক্ষণিক প্ররোচনাগুলোকে পরিহার করে এবং অনেক ক্ষেত্রেই ভয়-ভীতি, ক্ষয়-ক্ষতি, হুমকি, যুলুম-নির্যাতন ইত্যাদিকে মাথা পেতে নিয়ে মু’মিন ব্যক্তিরা যে সৎকাজগুলো করেন, মহান রাব্বুল আলামীনের কাছ থেকে তার প্রতিদান কতই না মূল্যবান হতে পারে!